সেক্সুয়াল ডাইমরফিজমের (Sexual Dimorphism) বলে একটা জিনিস আছে।
ব্যাপারটা হল- স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতির শারিরীক গঠনে স্পষ্ট কিছু পার্থক্য থাকবে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আজমল স্যারের প্রাণিবিজ্ঞান পড়ার সময় আমার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগত-
১। স্ত্রীদের হৃদপিন্ড কেন পুরুষের চেয়ে ছোট?
২। স্ত্রীদের পেশি কেন পুরুষের চেয়ে কম? কেন স্ত্রীরা জিম করলে পুরুষের মত পেশি ফুলে উঠে না?
৩। কেন স্ত্রীদের বৃক্ক, পুরুষের বৃক্ক অপেক্ষা ওজনে ও আঁকারে ছোট?
৪। কেন স্ত্রীদের স্তন থাকে, পুরুষের স্তন কেন নিষ্ক্রিয়?
৫। কেন স্ত্রীদের কোমরের (শ্রোণিদেশ) অস্থিগুলোর ব্যাস বেশি, কেন পুরুষের ক্ষেত্রে সংকুচিত?
৬। কেন স্ত্রীদের চেয়ে পুরুষরা বেশিই হিংস্র?
৭। স্ত্রীদের চামড়া কেন মোলায়েম, উজ্জ্বল এবং নরম। কেন পুরুষের চামড়া আলাদা?
৮। কেন পুরুষের শক্তি বেশি স্ত্রীদের তুলনায় বেশি?
৯। কেন স্ত্রীরা পাখির মত খুটিয়ে খুটিয়ে খায়, অল্প খায়? কেন পুরুষরা ভোজনপ্রিয়?
১০। কেন আমাদের মায়েরা পয়ত্রিশের পর স্থুলতায় ভোগে।
১১। কেন স্ত্রীদের মুখ গোলগাল, কেন পুরুষের মুখ লম্বাটে?
১২। কেন স্ত্রীদের চোখ সুন্দর? ভ্রু অনেক উপরে থাকে? কেন পুরুষের ভ্রু চোখের সাথে মিশে যায়?
আরো এক কোটি প্রশ্ন!
সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে দুই লাইনে বলি- সেক্সুয়াল ডাইমরফিজম কী!
পৃথিবীতে তখন এককোষী প্রাণিদের রাজত্ব। সবেমাত্র এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণির আবির্ভাব হল। শুরু হল পর্ব নামের জটিল টপিক। পর্বের নাম পরিফেরা।
যেহেতু প্রথম পর্ব, স্বাভাবিকভাবে এই পর্বের প্রাণিদের কিছুই ঠিকঠাক নাই।
মানুষ যেমন সবাই একই রকম। হাত পা মাথা নাক কান থাকবে। পরিফেরার হাত পা মাথা নাই। কেউ একই রকম দেখতে নয়। একই প্রজাতির পরিফেরার কেউ দেখতে গাছের মত, কেউ দেখতে ফুলদানির মত কেউবা দেখতে ঘন্টার মত।
আবার পরিফেরার প্রাণিদের গায়ের রঙ খেয়াল করো। কেউ দেখতে লাল, কেউ নীল, কেউবা সবুজ। নানা রঙ্গের।
এদের নারী পুরুষ বলে আলাদা কিছু নাই। সবাই একই গঠনের।
এরপর আরেকটু উন্নত প্রাণি চলে আসল। শুরু হল- নিডারিয়া নামক প্রাণি। এদের আকৃতি সবারই কাছাকাছি। একই ধরণের। একই প্রজাতির সবার রঙ একই রকম। কিন্তু কেউ পুরুষ কিংবা স্ত্রী নয়। সবাই একই। বা উভলিঙ্গিক। কিন্তু একই দেহে প্রজনন হয় না। একজনের শরীরের শুক্রাণু আরেকজনের ভেতর যাবে। ফলে নতুন প্রাণি জন্ম নিবে। অথচ কেউ নারী বা কেউ পুরুষ নয়।
এদের চেয়েও উন্নত পর্ব চলে আসল।
নাম হল- প্লাটিহেলমিনথিস। প্রজনন ব্যবস্থার খানিকটা উন্নয়ন হল। এরা উভলিঙ্গিক। নিজেরা একাএকা, নিজের শরীরের ভেতরেই শুক্রাণু ডিম্বানুর মিলন ঘটিয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়। ফলে আরেকজন প্রাণি লাগে না। যেমন ফিতা কৃমি। প্রজনন বা বংশবিস্তারের জন্য দুটো প্রাণী লাগে না বলেই, একটা কৃমি একাএকাই কোন বড় প্রাণির শরীরের ভেতরে বংশবিস্তার করতে পারে।
এরপর আসল নতুন পর্ব। নেমাটোডা নামক কৃমি। প্রথমবার পৃথিবীতে আসল নারী ও পুরুষ প্রাণি। এরা একা সন্তান জন্ম দিতে পারে না। সবসময় দুট প্রাণি লাগে। একজন হবে নারী আরেকজন হবে পুরুষ। যাদের দেখলেই বোঝা যায়, কোনটা নারী আর কোনটা পুরুষ। দুই ধরণের শরীরের দুই ধরণের গঠন।
নেমাটোডার পরের সব পর্বেই এই সুবিধা আছে।
ঘাসফড়িং আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণি। তাদেরও নারী ও পুরুষ আছে। আমরা এই অধ্যায় পড়ার সময় স্ত্রী ও পুরুষের পার্থক্য দেখতে পাই বইতে।
মানুষ নিজেও নারী ও পুরুষভেদে আলাদা। দুইটি (Di) আলাদা লিঙ্গের (sex) শারিরীক গঠনগত (Morphology) পার্থক্যের নাম- Sexual Di-Morphism.
উপরের সুবিশাল আলোচনা টানার কারণ আছে।
আমি আসলে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলাম, নারী ও পুরুষের শারিরীক গঠনে কেন পার্থক্য থাকে?
এবার আসি, তুলনামূলক ব্যাখ্যায়।
স্ত্রীদের হরমোনের নাম- ইস্ট্রোজেন।
পুরুষের হরমোনের নাম- টেস্টোস্টেরন (টেস্টোস্টেরন স্ত্রীদেরও আছে কিন্তু পরিমানে খুবই কম)।
টেস্টোস্টেরন পরিমাণ যার যতবেশি, তার পেশি ততবেশি থাকবে। যার যত বেশি পেশি, তার ততবেশিই হিংস্রতা থাকবে।
পেশি বেশি হলে সেই পেশিগুলোকে পুষ্টি এবং অক্সিজেন দেবার জন্য মোট রক্তের পরিমাণও বেশি হতে হবে। বেশি রক্ত হলে রক্তকণিকাও (পূর্ণবয়স্ক স্ত্রীদেহে লোহিত কনিকাঃ ৪৮ লাখ/ঘনমিলি কিন্তু পুরুষে ৫৪ লাখ/ঘন মিলি রক্ত) বেশি হবে।
বেশি রক্তের জন্য রক্তনালীর ভেতরের ব্যাসও বেশি পুরুষে।
হৃদপিন্ড যেহেতু সারাদেহে বেশি বেশি কোষে রক্ত দিবে, তাই পাম্প করবে খুব শক্তি নিয়ে। ফলে সেই চাপকে ধারণ করার জন্য রক্তনালীর দেয়ালও পুরু হবে।
বেশি কোষে রক্ত দেবার জন্য, বেশি চাপ দিতে হবে। চাপ দিবে হৃদপিন্ড। তাই হৃদপিন্ডের দেয়ালও পুরু হবে। পুরু দেয়াল হলে বেশি চাপ সহ্য করতে পারে।
হৃদপিন্ডের দেয়াল পুরু হলে, রক্ত পরিমানে বেশি থাকলে পুরুষের হৃদপিন্ডের আকারও বেশি হবে।
খেয়াল করুন, হৃদপিন্ডের দেয়াল পুরুষে বেশি পুরু। পুরু হবার একটা সুবিধা আছে। হার্ট এটাকের পরিমাণ সমান হলেও পুরুষ সহজে মারা যাবে না। কারণ তার দেয়াল পুরু, কোষ বেশি। কিছু কোষে এটাক হলেও বাকীকোষগুলো হৃদপিন্ডকে চালিয়ে নিবে।
বেশি রক্ত হওয়ায়, বেশি রক্তকে ফিল্টারের জন্য কিডনির আঁকারও বেশি হতে হয়। ফলে পুরুষ দেহে কিডনির আঁকার ও ওজন স্ত্রী অপেক্ষা বেশি।
স্ত্রীদেহের সব উল্টো।
পেশি কম।
পেশি কম হবার জন্য কম পেশিকোষে পুষ্টি দেবার জন্য রক্তও কম।
রক্ত কম হবার কারণে রক্তকনিকাও কম।
কম পেশি ও কম রক্তের জন্য হৃদপিন্ডের আঁকারও কম। রক্তনালীর ব্যাস কম। পুরুত্ব কম। একইভাবে হৃদপিন্ডের আঁকার কম। তেমনই দেয়ালের পুরুত্বও কম। পুরুত্ব কম হবার কারণে একই পরিমাণ হার্ট এটাকে স্ত্রীরা বেশি ক্ষতিগ্রন্থ হয়। কারণ পেশি অল্প। সেগুলোতে এটাক হলে সাপ্লিমেন্টারি দেবার মত যথেষ্ট পেশিকোষ থাকে না। তাই মৃত্যুহারও বেশি।
রক্ত কম হবার কারণে কিডনির আঁকারও কম।
এবার আসি, স্তনগ্রন্থি।
যেহেতু স্ত্রীদের পেটে সন্তান ধারণ করতে হয়, তাই তার কোমরের আঁকারও বড়। অতিরিক্ত অঙ্গ (জরায়ু) ধারণ করার কারণে কোমরের (শ্রোণিদেশ) অস্থিচক্রের ব্যাস বেশি (পেলভিসের আঁকার বড়)।
সন্তান ধারণ করে না বলেই পুরুষের পেলভিসের ব্যাস কম।
স্ত্রীরা সন্তান জন্মের পর একটানা ছয়মাস সন্তানকে খাবার দিয়ে সুস্থ রাখবে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল- এই খাবারের উৎস সেই শরির, যে শরীর থেকে কজন সন্তান জন্ম নেয়। পুরুষ যেহেতু সন্তান জন্ম দেয় না, তাই তার স্তনগ্রন্থি থাকলেও সেটা সক্রিয় নয়।
সক্রিয় স্তনগ্রন্থির প্রচ্ছছেদের ছবি যদি তোমরা কখনো দেখো, দেখতে পাবে স্তনের ভেতরে তেঁতুল পাতার মত অসংখ্য দুগ্ধ নিঃস্মরণকারী গ্রন্থি বা থলি আছে। থলিগুলো নালীর মাধ্যমে নিপলের কাছে এসে একসাথে হয়ে বের হয়। এতগুলো তেঁতুল পাতার মত একটার পর একটা সাজানো স্তনগ্রন্থির থলিকে চাপ কিংবা আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চারপাশে চর্বি জমা হতে থাকে। চর্বি স্তনগ্রন্থিকে আঘাত ও দুগ্ধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
কেন পুরুষের শক্তি বেশি?
গবেষণা নানা কথা বলে। দেহের উপরের অংশে পুরুষের যা শক্তি, নারীদের তার অর্ধেক শক্তি। আবার শরীরের নিচের অংশের শক্তি পুরুষের থেকে এক তৃতীয়াংশ কম। কেন?
পুরুষ খাবার খেলে সেগুলো দ্রুত হজম হয়। দ্রুত হজম হলে দ্রুত শক্তিও উৎপন্ন হয়। পেশিকে দ্রুত শক্তি দিতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের পেশিশক্তি হবে স্ত্রীদের চেয়ে বেশি।
আবার নারীদের ক্ষেত্রে হজমকৃত খাবার ধীরেধীরে শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে খাবারের একটা বড় অংশ শক্তি না হয়ে আগেই চর্বিতে পরিণত হয়। এই চর্বি জমা থাকে স্তনে, পেটে, কোমরে এবং বাটক-এ। চর্বির বিশাল একটি অংশ জমা হয় চামড়ার নিচে, সারাশরীরে। ফলে স্ত্রীদের চামড়া মোলায়েম এবং নরম হয়।
বুদ্ধিমত্তা এবং মস্তিষ্কের আয়তনেও একটা পার্থক্য আছে।
পুরুষের মস্তিষ্কের আঁকার স্ত্রীদের তুলনায় ১০ ভাগ বড়। কিন্তু পুরুষরা ব্যবহার করে মস্তিষ্কের একপাশ (সেরেব্রাল হেমিস্ফেয়ার)। স্ত্রীদের ১০% ছোট হলেও মস্তিষ্কের দুই অংশের মধ্যে অনেক বেশি স্নায়ু সংযোগ থাকে। ফলে দুটো অংশই স্ত্রীরা ব্যবহার করতে পারে। আরো নিখুঁতভাবে, শুদ্ধভাবে কাজ করতে পারে। এজন্যই ছোটখাটো জিনিস ছেলেরা ভুলে গেলেও মেয়েরা সহজে ভুলে যায় না।
স্ত্রীদের হরমোনের নাম- ইস্ট্রোজেন। পুরুষের হরমোনের কারণে পুরুষরা অনেক সুবিধা পেলে নারীরা তাদের হরমোনের ক্ষেত্রে তেমন সুবিধা পাবে না?
অবশ্যই পাবে।
ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণে বিশাল পরিবর্তন দেখা যায় স্ত্রীদের মধ্যে।
ধরা যাক, মুখের কথা।
স্ত্রীদের ভ্রু ছেলেদের তুলনায় উঁচুতে। ঠোঁট ছেলেদের চেয়েও বেশি পেশিবহুল। মুখমণ্ডল গোলাকার। কিন্তু থুতনী খাঁড়া এবং সহজেই মুখ থেকে আলাদা বোঝা যায়।
ছেলেদের ক্ষেত্রে গোলগাল নয়। ভ্রু চোখের সাথে লাগা। ঠোঁটে স্নিগ্ধতা নেই। মুখ গোলগাল না হয়ে খানিকটা চার কোনাকার বা লম্বাটে।
ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণেই স্ত্রীরা পুরুষের চেয়ে বেশিই শান্ত, সুস্থির, ভদ্র, নম্র।
এমনই... সেক্সুয়াল ডাইমরফিজমের কারণে আর হাজার হাজার পার্থক্য আছে স্ত্রী ও পুরুষের দৈহিক গঠনের মাঝে।
-ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
Nice
উত্তরমুছুন