করোনা সময়ে আপনি কি মিস করছেন? এই প্রশ্নটি করেছিলাম গ্রুপের অনেক মেম্বারকে যারা এখনো ছাত্র অবস্থায় আছেন। সবচেয়ে কমন বিষয় ছিলো ক্যাম্পাস। কেউ বলেছেন গ্রুপ স্টাডিজ, কেউ বলেছেন একাডেমীক। মিস করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারন আপনি কখনো এইভাবে বাড়িতে আটকে ছিলেন না। এখন বাড়িতে বসে আমরা আমাদের সময়টুকু কতটুকু কাজে লাগাচ্ছি? সময় কাজে লাগাতে গিয়ে আমরা কি লাইফের এই প্রয়োজনীয় সময়টাতে কোন ভুল কি করছি? ভুল হতেই পারে, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়াটা ভুলের চেয়েও মস্ত ভুল সাথে বোকামী ও নির্বোধ এর পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আর সফল হতে চাইলে আমাদের অনেক অনেক ভুল করতে হবে, তারপরও হার মানা যাবে না। ওই ভুল থেকে অনবরত শিখে যেতে হবে।
আজ এখানে পাচটি মারাত্বক ভুল নিয়ে আলোচনা করবোঃ
ভুল নম্বর ১: খারাপ সঙ্গে প্রভাবিত হওয়াঃ
এই গল্পটির সত্যতা আমার জানা নেই। আইনস্টাইনের যিনি ড্রাইভার ছিলেন। তিনি একদিন আইনস্টাইনকে বললেন –
আপনি প্রতিটি সভায় যে ভাষণ দেন সেইগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ।” -আইনস্টাইন তো অবাক!!!
উনি তখন বললেন “বেশ তাহলে এর পরের মিটিংয়ে যেখানে যাবো তারা আমাকে চেনেন না, তুমি আমার হয়ে ভাষণ দিও আর আমি ড্রাইভার হয়ে বসে থাকবো ।”
-এরপরে সেই সভায় তো ড্রাইভার হুবহু আইনস্টাইন-এর ভাষণ গড় গড় করে বলে গেলেন । উপস্থিত বিদ্বজ্জনেরা তুমুল করতালি দিলেন । এরপর তাঁরা ড্রাইভারকে আইনস্টাইন ভেবে গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলেন ।
-সেই সময়ে একজন অধ্যাপক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন “স্যার, ঐ আপেক্ষিক এর যে সঙ্গা টা বললেন, আর একবার সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেবেন?”
-আসল আইনস্টাইন দেখলেন বিপদ, এবার তো ড্রাইভার ধরা পড়ে যাবে । কিন্তু তিনি ড্রাইভার-এর উত্তর শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন । ড্রাইভার উত্তর দিল।।
-“এই সহজ জিনিসটা আপনার মাথায় ঢোকেনি ? আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন সে বুঝিয়ে দেবে….
নীতিবাক্যঃ জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করলে আপনিও জ্ঞানী হবেন। আপনি যেমন মানুষের সাথে ঘুরবেন তেমনই হবেন।
কেমন লোকের সাথে বন্ধুত্ব কিংবা সঙ্গ করা উচিত ? ইমাম গাযযালী (রহঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং ৩টি গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। গুণ তিনটি হল-
১. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
২.বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময় এবং
৩. বন্ধুকে হতে হবে নেককার ও পুণ্যবান
ফরাসী এক প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘বন্ধুত্ব হলো তরমুজের মতো। ভালো একশটিকে পেতে হলে এক কোটি আগে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। ‘রাসূল (সাঃ) বলেছেন, শেষ বিচারের দিন সকল বন্ধুই শত্রুতে পরিণত হবে তবে একমাত্র সৎ বন্ধুই সেদিন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেবে। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্থতা প্রভৃতি গুণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বন্ধুত্ব যদি করতে হয় তাহলে ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।
হলিউডের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ড্রিউ ব্যারিমোর। ৭ বছর বয়সে তার হলিউড ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। যখন তিনি ১১ মাস বয়সের ছিলেন, তখন তাকে প্রথম চরিত্রের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
চলচ্চিত্র জগতের সাফল্য তাকে খুব নোংরা সামাজিক গোষ্ঠীর কাছে টেনে নিয়েছিল। নাইট লাইফ এবং ডান্স, বার পার্টি এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, এবং অবশেষে খুব খুব কম বয়সে তাকে ১৮ মাস পুনর্বাসনে থাকতে হয়েছে। নিজের আত্মজীবনী “Little girl Lost” তে জীবনের এই পর্বে তিনি খুব আফসোস করেছিলেন।
একইভাবে, আমরা সকলেই বিভিন্ন কুপ্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি, যা আমাদের অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে পারে। তাই এই সময়টাতে খুব সতর্ক হয়ে চলতে হবে।
Don’t be afraid to walk alone, after all a tiger doesn’t lose sleep over the opinions of sheep.
ভুল নম্বর ২: ছাত্র অবস্থায় উপার্জন করতে না শেখা
বেনটন গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি বড় ভাই রয় ডিজনির সাথে পত্রিকা বিলি করার কাজ শুরু করেন ওয়াল্ট ডিজনি। এই চরম দুঃসময়ে তার বড় ভাই রয় ডিজনিকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে পাশে পেয়েছেন। ভাইয়ের প্রতি তার বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা দুটোই ছিল বেশ। ভোর ৪ টা কখনও বা ৩.৩০ এ উঠে বেরিয়ে পড়তেন পত্রিকা বিক্রি করতে। কাজ শেষে ছোট একটা ঘুমের পর আবার রওনা হতেন স্কুলে।
স্কুল থেকে ফিরে আবারো পেপার বিক্রির কাজ। টানা ছয় বছর এই ক্লান্তিকর কাজ করে যান তিনি। ক্লান্তির জন্য কখনো কখনো ক্লাসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু আঁকাআঁকির প্রতি তার ভালোবাসা কমেনি কখনওই। আর্ট ক্লাসে চমৎকার সব স্কেচ করে অবাক করে দিতেন শিক্ষকদের। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটাকে তিলে তিলে বড় করতে থাকেন চর্চার মাধ্যমে। নিউজপেপার বিক্রির সুবিধায় কার্টুন এঁকে পেপারেও ছাপাতেন মাঝেমাঝে। কিছু বাড়তি আয়ও হয়ে যেত।
এরপর তো বাকীটা ইতিহাস। সেই ডিজনী নিজেকে কোন উচ্চতায় প্রতিষ্টা করেছিলেন তা কারো অজানা নয়।
আপনি যদি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর প্রান্তে বা যদি আপনি ইতিমধ্যে ছাত্র অবস্থায় থাকেন, তবে অবশ্যই কিছু পকেট খরচের অর্থ উপার্জন করা নিয়ে আপনার অবশ্যই চিন্তাভাবনা করা উচিত। উপরে ডিজনীর গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি। ছাত্র অবস্থায় ইন্টার্নশিপ, খণ্ডকালীন চাকুরী, অনলাইন চাকরী বা এমনকি ছোট খাটো ব্যবসার চেষ্টা করুন। মোট কথা হ'ল নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করা। সর্বোপরি, এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপটি এখান থেকেই শুরু করা।
The secret of getting ahead is to just get started.
ভুল নম্বর ৩: পছন্দের ক্যারিয়ার নিয়ে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া
আপনি বড় হয়ে কী হতে চান? ছাত্র অবস্থায় এই প্রশ্নটি শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কোন প্রকার কনফিঊশান না রেখে এক কথায় উত্তর দিন - "আমি জানি না"।
এলন মাস্ক, বিল গেইটস, ডক্টর ইউনুছ উনাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পড়াশোনা আর বর্তমান ক্যারিয়ার লাইফ এক নয়। একজন এলন মাস্ক ছোট বেলায় টেসলার মতো গাড়ী কোম্পানীর প্রধান, কিংবা বিল গেইটস সফটওয়্যার কোম্পানীর প্রধান, কিংবা ডক্টর ইউনুছ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সারা বিশ্বের জন্য সামাজিক অর্থনীতির জন্য কাজ করবেন তা কখনো ভাবেন নি।
আমাদের বড় ভুলটি তখন ঘটে যখন "হার্ড মেন্টালিটি" আমাদেরকে ঘিরে ধরে। আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবতে পারি না। বেনজমিন ফ্রাঙ্কলিনের ভাষায় ‘If everyone is thinking alike, then no one is thinking.’
সুতরাং, "আমি জানি না" বলাটা দোষ নয়। বরং চারপাশ থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্যারিয়ার গঠনের জন্য বিভিন্ন ধাপ পার হওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হওয়া চাই । আর প্রস্তুত হতে চাইলে অতীতের শিক্ষা নিয়ে এগিইয়ে যাওয়া উচিত নয়। এগোতে হবে বর্তমান থেকে যা শিখছি, তা নিয়ে। শুধু যন্ত্রের মতো সব মুখস্ত করলে, আমাদের আর যন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। চেষ্টা করতে হবে সৃষ্টিশীল হতে। নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচর্যা করতে হবে, আরও গঠনমূলক হতে হবে।
ভুল নম্বর ৪: কোন কিছু জানার আগ্রহ না থাকা, কোন বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে না তোলা।
গুগলে যদি প্রশ্ন করি, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত? আই ফোনে সিরিকে জিজ্ঞাসা করি, সূর্য ডুবে গেল কেন? এদের উত্তর শুনে আমরা আশ্চর্য হয়ে যায়। আমরা ভাবতে থাকি! অথচ এই গুগল, সিরি এগুলো আমাদের মতই মানুষের ভিন্ন ও উন্নত চিন্তা ভাবনার ফসল।
বাগানে একটি আপেল গাছের নীচে বসে ভাবছিলেন এক বিজ্ঞানী৷ হঠাৎ করেই, একটা আপেল টুপ করে পড়লো সেই বিজ্ঞানীর পায়ের কাছে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জাগলো প্রশ্ন, আপেলটা নীচে পড়ল কেন ? অন্য কোনো দিকে, অর্থাৎ ওপর দিকেও তো যেতে পারতো !
এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিল যুগান্তকারী এক তত্ত্ব৷ জন্ম নিল মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের৷ এই গল্প কিন্তু সবার জানা৷ তবে শুধু গল্পটাই নয়, স্কুল পড়ুয়া প্রায় সব ছেলে-মেয়েই জানে সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম - ‘আইজ্যাক নিউটন'৷
তাই প্রশ্ন করার অভ্যাস জাগিয়ে তুলুন। অন্যরা কি বল্লো তা নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। এমএসএফ এ কাজ করার সময় প্রতি মাসে আমাদের অনেক মিটিং এটেন্ড করতে হতো। মিটিং শেষে বিদেশী প্রজেক্ট ম্যানেজারগন জিজ্ঞাসা করতেন, আপনাদের কারো কোন প্রশ্ন আছে? একমাত্র আমিই সবসময় দাঁড়াতাম এবং প্রশ্ন করতাম আর সবার হাসির পাত্র হতাম। অনেকেই বলতো কারো কোন প্রশ্ন না থাকলেও সাঈদ এর একটা প্রশ্ন থাকবেই। এমনকি ম্যানেজারগন বলতেন, আমি জানি তোমার কাছে থেকে প্রশ্ন আসবে। আমি এই গুলো কখনো তোয়াক্কা করতাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন গুলোর কারনে অনেক সমস্যার সমাধান হতো। ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে - He who asks questions remains a fool for five minutes, but he who does not ask, remains a fool forever.
ভুল নম্বর ৫: ডিজিটাল রিলেশনশিপ
স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে লাইফ স্মার্ট করতে গিয়ে পারিবারিক রিলেশনে আনস্মার্ট হয়ে যাচ্ছি। কোথায় বেড়ালাম, কোথায় খেলাম, সাথে সাথে ফেসবুজ, ইন্সটগ্রামে পোস্ট, এরপর অপেক্ষা কখন লাইক আসে, কখন কমেন্ট আসে। দিন শেষে কাউন্ট করি কি পরিমান লাইক শেয়ার কমেন্ট হয়েছে। থামুন। এটা জীবন নয়। মেসেঞ্জারে রাতের পর রাত জেগে চ্যাট করে রিলেশনশীপ তৈরী, এরপর নেট দুনিয়ায় ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারকের খপ্পরে পড়া এখন আর নতুন কিছু নয়। আমাদের মোবাইল ফোন অন্যের সাথে ভার্চুয়াল রিলেশন যতই কাছে করুক না কেন, কাছের মানুষ গুলোকে দিনের পর দিন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
একটা কথা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত, লাইভ ইন্টারঅ্যাকশন কেবল আমাদের কথাবার্তার দক্ষতাই নয়, সামগ্রিক ভাবে আমাদের ব্যক্তিত্বকেও উন্নত করে। এছাড়াও, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত যে, লাইভ ইন্টারঅ্যাকশন নিজের দেহ, মন মানসিকতা কে উন্নত, সুখী এবং সুষম অবস্থার দিকে পরিচালিত করে।
আপনার মোবাইল ফোন আপনাকে ফেসবুক, ইন্সটগ্রাম, ক্যামেরা, ক্যালেন্ডার, ঘড়ি এবং অ্যালার্ম ঘড়ি দিয়েছে, কিন্তু এটি আপনাকে কখনো প্রকৃত বন্ধু এবং পরিবার দিবে না।
সামগ্রিকভাবে উপরের এই ভুল গুলো আমরা যতদিন চালিয়ে যাবো, ততদিন ঠিকই মনে হবে। যেদিন দেরী হয়ে যাবে, সেদিন আর শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
শুভ কামনা।
লেখকঃ সৈয়দ জাহেদ হোসেন
0 মন্তব্য(গুলি):